চলে গেলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, জেনে নিন তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য

স্টিফেন উইলিয়ম হকিং(Stephen hawking) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী, ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ ৭৬ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। স্টিফেন হকিং- এই বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব গোটা বিশ্বের দরবারে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসাবে পরিচিত। সমস্ত রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বিজ্ঞানের জগতে তাঁর অবদান অপরিসীম।

কেমব্রিজের বিশ্বাবিদ্যালয়ে থাকাকালীন খুব কম বয়সেই এমায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস (এ.এল.এসের ) নামে কঠিন রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তিনি শারীরিক ভাবে ক্রমশ অচল ও অথর্ব হয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর গবেষণার কাজ সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যেতে থাকেন। এটি একধরণের স্নায়ুরোগ। তাঁর রোগটি ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং তাঁর পেশী ও স্নায়ুর উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালে তিনি নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হন এবং তাঁর ২৪ ঘণ্টার নার্সিং কেয়ারের প্রয়োজন হয়। ডঃ হকিংয়ের অবিশ্বাস্য দৃঢ়সংকল্প এবং তাঁর পরিবারের সহযোগীতায় তিনি ৭৬ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ২০১৮ সালের মার্চ মাসের ১৩ তারিখ, তার জীবনাবসানের পূর্বের দিন পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিক্সের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে আইজাক নিউটনের চেয়ার অধিষ্ঠিত করে ছিলেন।

তিনি ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসীয় অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২০০৯ সালের ১লা অক্টোবর এই পদ থেকে অবসর লাভ করেন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিল এবং কেইয়ুস কলেজের ফেলো হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো ছিলেন । পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি।



পদার্থবিজ্ঞানে স্টিফেন হকিং এর অবদান

পদার্থ বিজ্ঞানে স্টিফেন হকিং এর দুটি অবদান সর্বত্র স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরাজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। ১৯৮৩ সালে জিম হার্টলের সাথে মহাবিশ্বের আকার আকৃতি সর্ম্পকে অজানা তথ্য আবিষ্কার করেন প্রচলিত ধারণা ছিল ব্ল্যাক হোল থেকে আলোর কণাও বাইরে আসতে পারে না। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব ব্ল্যাক হোল-এর ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে অথবা কখনো কখনো বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ নামে অভিহিত।

স্টিফেন হকিং এর লেখা কয়েকটি বই

হকিং তাঁর নিজের তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে A Brief History of Time (আ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম) নামে একটি বই রচনা করেন । বইটি ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং জুন মাসে যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং এটি অসাধারণ বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করেছিল। বইটি রেকর্ড ভঙ্গ করা ২৩৭ সপ্তাহ ধরে ব্রিটিশ সানডে টাইমসের সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকায় ছিল।

তাঁর লেখা বই theory of everything(থিওরি অফ এভরিথিং)- এই বইটির মূলত যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে তা হল- বিজ্ঞানীরা আমাদের বিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে একক তত্ত্বকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের অতীত ও বর্তমান উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে জটিল তত্ত্বগুলি উপস্থাপন করেছেন এই বইটিতে।

২০০৭ সালে স্টিফেন হকিং তার মেয়ে লুসি হকিং এর সাথে মিলে ছোটোদের বই লিখেছিলেন George’s secret Key to the Universe-এই বইটি জর্জ নামের একটি ছোটো বালকের কাহিনী কিন্তু যাতে রয়েছে ব্ল্যাকহোলসহ নানা বৈজ্ঞানিক ধারণা। ২০০৯ সালে বের হয়েছে এই বইয়ের পরবর্তী পর্ব। এছাড়াও তিনি আরও অনেক বই রচনা করেছেন।

আরও জনপ্রিয় খবর জানতে ক্লিক করুন
স্টিফেন হকিং এর জণ্ম ও পরিবার

১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি স্টিফেন হকিং জন্মগ্রহণ করেন অক্সফোর্ডে।গ্যালিলিও গ্যালিলির মৃত্যুর ঠিক তিনশত বছর পরে তাঁর জণ্ম হয়। আলবার্ট আইনস্টাইনের জণ্ম দিন ১৮৭৯ সালের ১৪ই মার্চ এবং সেই একই দিনে মৃত্যু হয় স্টিফেন হকিং এর। হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার মা ছিলেন স্কটিশ। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন। লন্ডনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতির সময় নিরাপত্তার খাতিরে হকিং গর্ভে আসার পর তারা অক্সফোর্ডে চলে যান।



স্টিফেন হকিং এর শিক্ষাজীবন

হকিংয়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয় লন্ডনের হাইগেটের বাইরন হাউজ স্কুলে।হকিং হার্টফোর্ডশায়ারের র্যাুডলেট গ্রামের র্যা ডলেট স্কুলে এক বছর পড়াশুনা করেন। ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবান্‌স নামক অপর একটি স্বাধীন স্কুলে পড়াশুনা করেন।

১৯৫৯ সালের অক্টোবরে ১৭ বছর বয়সে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তাঁর স্নাতক পাঠগ্রহণ শুরু করেন। কেমব্রিজে আসার পরপরই হকিং মটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হোন। এই রোগে তাঁর প্রায় সকল মাংসপেশী ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসে। কেমব্রিজে প্রথম দুই বছর তাঁর কাজ তেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু, রোগের প্রকোপ কিছুটা কম হলে, হকিং তাঁর সুপারভাইজার ডেনিশ উইলিয়াম শিয়ামার সাহায্য নিয়ে পিএইচডির কাজে এগিয়ে যান।

স্টিফেন হকিং এর কর্মজীবন

হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র ছিল কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষ। ১৯৬০ এর দশকে তাঁর সহকর্মী রজার পেনরোজের সাথে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। ১৯৭০ এর দশকে হকিং তাঁদের তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন যা পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব নামে পরিচিত।

আরও জনপ্রিয় খবর জানতে ক্লিক করুন
স্টিফেন হকিং এর বিবাহ

গ্রাজুয়েশন শেষ করে ক্রিসমাসের ছুটিতে বাড়ি আসতেই তার পরিবারের সদস্যরা তাঁর অসুস্থতার বিষয়টি খেয়াল করেন। সেই সময়ই নিউ ইয়ার পার্টিতে দেখা হয় জেনের সাথে।কেমব্রিজে হকিং যখন স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তখন জেন ওয়াইল্ডের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেন ছিলেন তাঁর বোনের বান্ধবী। ১৯৬৩ সালে হকিংয়ের মোটর নিউরন রোগের চিকিৎসার পূর্বে জেনের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ই জুলাই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

স্টিফেন হকিং এর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননা



২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজি কেন্দ্রে হকিংয়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে অবস্থিত আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের সামনে ২০০৮ সালের মে মাসে হকিংয়ের আর একটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয় মধ্য আমেরিকায় এল সালভাদর তাদের রাজধানী সান সালভাদরে বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম হকিংয়ের নামে রেখেছে।

এছাড়া তিনি তার কর্মক্ষেত্রে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন।

  • ১৯৬৬ সালে অ্যাডামস পুরস্কারে ভূষিত হন।
  • ১৯৭৫ সালে এডিংটন পদক পান।
  • ১৯৭৬ সালে গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় ড্যানি হাইনম্যান পুরস্কারে এবং হিউ পদকে পুরস্কৃত হন।
  • ১৯৭৮ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন পদক পান।
  • ১৯৮৭ সালে ডিরাক পুরস্কারে ভূষিত হন।
  • ১৯৮৮ তে পান উলফ পুরস্কার।
  • ১৯৮৯ তে পান প্রিন্স অব অ্যাস্টুরিয়াস পুরস্কার।
  • ১৯৯৮ তে পুরস্কৃত হন অ্যান্ড্রু গেম্যান্ট পুরস্কারে।
  • ১৯৯৯ তে পান নেলর পুরস্কার ও লেকচারশিপ এবং রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের আলবার্ট পদক।
  • ২০০৬ সালে পান কপলি পদক।
  • ২০০৯ সালে ভূষিত হন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম।
  • ২০১২ সালে ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স পুরস্কারে ভূষিত হন।
  • ২০১৫ সালে পান ফাউন্ডেশন ফ্রন্টিয়ারস অব নলেজ পুরস্কার।

তবে সবশেষে সমস্ত পুরস্কারকে উপেক্ষা করে ২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ বিজ্ঞান জগতে তাঁর অসামান্য অবদান রেখে চলে গেলেন পরলোকে। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

আরও জনপ্রিয় খবর জানতে ক্লিক করুন

Comments

comments

এই সংক্রান্ত আরও খবর